বাংলাদেশের
একটি বিয়ের যত অনুষ্ঠান
এই বঙ্গে সুপ্রাচীন
কাল থেকেই সবকিছু ঐতিহ্যের ধারা ও প্রথা হিসেবেই প্রচলিত, বাংগালীর প্রাণে প্রাণে
গ্রথিত। তথাপি এতেও আছে ব্যাপক বৈচিত্র্য, যার প্রতিফলন খাদ্যরীতি থেকে শুরু করে সকল আচার
বিধিতেই প্রতিবিম্বিত হয়। এবং একটি বিয়েতে এই ঐতিহ্যের উৎসবমুখর রূপটির সর্বোচ্চটাই
উপস্থাপিত হয়।
এক টুকরো নিবন্ধে এই দেশীয় বিবাহের এতো সমস্ত বর্ণাঢ্য ঐতিহ্য
বর্ননাসহ তুলে ধরা সত্যিই এক হারকিউলিয়ান কাজ বটে। তাই বরং বলা যাক , এই নিবন্ধনটি
বর্তমানের একটি বিয়ের সকল ঐতিহ্যের মাত্রাধিক রঙ্গীন ও বর্নিল সুবিশাল কর্মযজ্ঞের
এক ঝলক তুলে ধরার বিনীত প্রচেষ্টা মাত্র ।
আমাদের সংস্কৃতিতে বিবাহ দুটি ব্যক্তির পবিত্র মিলনকেই প্রতীকী
করে না, বরং দুটি পরিবারকেই জোটবদ্ধ করে তোলে এবং সম্পর্কের ক্ষেত্র প্রসারিত করে। এতে পরিবারের
ভূমিকা এতোটাই বেশী গুরুত্বপূর্ন ও গভীর যে সাধারণত পরিবারই কনে (বউ)বা বরের ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকৃতপক্ষে,
কয়েক দশক আগে পর্যন্ত
বর এবং কনে তাদের বিয়ের দিন একে অপরকে প্রথম দেখতে পেতো। তবে এই প্রবণতাটি শহরাঞ্চলে
পরিবর্তিত হয়েছে , এবং একালের তরুণ প্রজন্ম তাদের জীবনসঙ্গী বেছে
নেওয়ার ক্ষেত্রে এই অগ্রসরময়তা আরও বিস্তারিত বলতে পারে।
ঘটোক: ম্যাচমেকার
ম্যাচ মেকার মূলত বিবাহ উপযোগী একটি জুটিকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ
করতে ইচ্ছুক পরিবারের ভেতরে সংযোগ স্থাপন করে বা সহায়ক ভূমিকা পালন
করে। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি দুটি পরিবারের মধ্যে সম্ভাব্য ভুল বোঝাবুঝির সমাধান করেন। তিনি উভয় পরিবারকে
অপর পরিবারের পারিবারিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য অবহিত করেন। পাত্র পাত্রীর
প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা, কর্মসংস্থান, ব্যবসায়িক , সামাজিক যোগাযোগ এবং অন্যান্য সমস্ত কিছু অবগত করা হয়। সামাজিকভাবে,
গ্রামীণ ও শহুরে উভয়
পরিবারেই দীর্ঘকাল ধরে 'ঘটোক' এর সেবা নেয়া হয়েছে। পেশাদার ঘোটককে এই পরিষেবার জন্য উপযুক্ত
সন্মানী প্রদান করা হয়। এছাড়া অর্থনৈতিক লেনদেন ছাড়াও পারিবারিক বন্ধু
বা আত্মীয়ও বহু ক্ষেত্রে ঘটকালীর কাজটি নিজ উদ্যোগেই বা পরিবারের অনুরোধে করে
থাকেন। আজ, যদিও ম্যাচমেকিং ওয়েবসাইট রয়েছে এবং এদের আছে বহুবিধ উপায়ে ক্লায়েন্টের কাছে পৌঁছানোর কার্যকর উপায়।
তবে এই আয়োজনের মাধ্যমে জুটিটি উপযুক্ত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য ম্যাচ মেকিং এর মূল উদ্দেশ্যটিকে 'পাল্টা পল্টী ঘর'
বলা হয়।
পাকা কথা: ছেলে মেয়ের সাক্ষাৎ পর্ব
এই দিনেই সম্ভাব্য কনের বাড়িতে সম্ভাব্য বরের পরিবার
সকল আলাপ পর্ব সম্পন্ন করে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন । চূড়ান্ত চুক্তি হওয়ার আগে তারা
আনুষাঙ্গিক তথ্য ও সৌহার্দ্য
বিনিময় করতে এবং এক পরিবার অপর পরিবারকে ভালোভাবে জানতেই এই সাক্ষাৎ করেন । এদিন যদিও বর কনের
সাক্ষাৎ সেই অর্থে (অনেক ক্ষেত্রেই) হয়না। তবু উভয় পক্ষ, যদি খুব বেশী রক্ষনশীল না হয়, তবে হবু জুটিকে
কিছুটা আলাপের , দুজন একটু আলাদা বা একান্তে প্রাথমিক সাক্ষাতের সুযোগ
করে দেন । এদিনে ছেলেটি ফর্মাল স্যুট বা পাঞ্জাবী স্যুট না পরে ক্যাজুয়াল পোশাকে এলেও
মেয়েটিকে প্রথাগতভাবে শাড়ীই পরতে দেখা যায়।
পানচিনি : এনগেইজমেন্ট
আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন জুটির বন্ধন চুড়ান্ত হয় এই
অনুষ্ঠানে। গ্রাম বাংলায় বা প্রাচীন বাংলায় যে
কোনো শুভ অনুষ্ঠানে অতিথিদেরকে পান সুপুরি দিয়ে অভ্যর্থনা
করা ছিল একটি রীতি। 'পান' যখন রুপালী রাংতায় মুড়ে পরিবেশন করা হয় তখন
তা কোনো বিশেষ উৎসবের শুভ বার্তা বহন করে। এই জাতীয় অনুষ্ঠানে মিষ্টি আনাও
অতি প্রচলিত ও আবশ্যিক অংশ। পানচিনি নামটি এসকল পরিবেশন থেকেই হয়েছিল। এই সকল
আনুষ্ঠানিকতা ও আচার এক নতুন সেতুবন্ধনের হৃদয়গ্রাহী প্রতিশ্রুতি দেয়।
বিবাহের ঘোষণাঃ দাওয়াত পর্ব
এর উদ্দেশ্য উভয় পক্ষের পূর্ন সম্মতিতে বিবাহের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা; একই সংগে শেষ সময়ে কোনো আপত্তি থাকলে সেটিরও সুযোগ দেয়া । পুরানো দিনগুলিতে অতিথিদের বাড়ী
বাড়ী গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ জানানো হতো । কিন্তু ভয়ানক ব্যস্ত নাগরিক জীবনে ফোন, পোস্টাল
মেইলের মাধ্যমে পাঠানো নিমন্ত্রণপত্র , এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও পোস্ট বা মেসেজ করে
ভার্চুয়াল নিমন্ত্রণ পত্রে নিমন্ত্রণ করা হয়। মূলত এতে বাড়ির লোকেরা আসন্ন বিয়ের
তারিখগুলি সম্পর্কে অগ্রীম অবহিত করে যাতে আমন্ত্রিতরা নিজেকে সেদিন অন্য কোনো কাজ থেকে মুক্ত রাখে। দ্বিতীয়ত এটি বিবাহিত দম্পতিদের পরিবার ,
অঞ্চল , আবাস সম্পর্কেও সম্মানিত আত্মীয় এবং বন্ধুদের কাছে পরিচিতি দেয়।
আইবুড়ো ভাত: একটি বিশেষ উৎসব
এটি বিবাহিত জীবনের প্রবেশের আগে নিজের ঘরে আয়োজনের
মাধ্যমে উপভোগ করা শেষ খাবারটিকে বোঝায়। এই ঘরোয়া ভোজ উৎসবের জন্য আহ্বান জানানো হয় কনের বিস্তৃত পরিবার
এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের। আমন্ত্রিতরা উদযাপনে যোগ দেয় এবং কনেকে শুভকামনা জানায়। 'আই বুড়ো ভাত' ভোজের মধ্যে সাধারণত
বাঙালি খাবার যেমন ভাত, মাছ, লুচি, শাকসব্জি , তরকারী এবং মিষ্টি জাতীয় খাবারের ভেতরে বিভিন্ন পিঠা
পুলী, এছাড়াও অন্যান্য জনপ্রিয় ও
কনের প্রিয় খাবার থাকে।
অপরপক্ষে , কখনও কখনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজন হবু বঁধুকে তাদের বাড়িতে ভোজের
জন্য আমন্ত্রণ জানায় এবং আয়োজন করে কনের পছন্দের সমস্ত খাবার প্রস্তুত করে কনেকে আপ্যায়ন করে।
গানের জলশা: লাইভ মিউজিক
বিবাহের মহল বা আবহাওয়া
তৈরী করতে বিয়ের মূল অনুষ্ঠানের পূর্বে আয়োজিত সকল অনুষ্ঠানের ভেতর ঘরোয়া সংগীতের আসর একটি দুর্দান্ত আয়োজন। এদিন বন্ধুরা এবং পরিবারের লোকজন পরিবেশন করেন
অতীত এবং
বর্তমানের ভালবাসার গানগুলি । যদিও মূলত এই দিনটিতে পেশাদার শিল্পীদের ভাড়া করা হয় । তবে নিজেদের মানুষদের অংশগ্রহনেই
এটি হয় বেশী শোভন, সুন্দর এবং আমেজে থাকে ঘরোয়া ছাপ। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে প্রায়শই গানে গানে অন্তমিল গেইমগুলি খেলা হয়। এটি জনপ্রিয় এবং আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে আমদানীকৃত একটি সাংস্কৃতি ।
গানের সাথে কখনো নাচও এই পার্টির আমেজকে বহুল উজ্জীবিত করে। প্রচলিতভাবে এটি একটি পরিনত রাতের আয়োজন , রাতের
খাবারের পরই এটি উদযাপিত হয়। তাই সেখানে চা, আহারাদি এবং মিষ্টান্ন পরিবেশিত
হয়।
গায়ে হলুদ : প্রাক বিবাহ অনুষ্ঠান
এটি কনে এবং বর উভয়ের জন্য প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠান। অতীতে এটি
একটি পারিবারিক বিষয় ছিল যেখানে মহিলারা অংশ নিত এবং পুরুষদের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার অনুমতি মিলতো না ।
বিবাহ-পূর্ব বিউটিফিকেশন অনুষ্ঠান হিসাবে নববধূ হলুদ এবং অন্যান্য
সুগন্ধযুক্ত বিভিন্ন হার্বাল পন্য দিয়ে চর্চিত হন। প্রচলিত রীতিতে কনের হলুদ অনুষ্ঠান বরের গায়ে
হলুদের আগের দিন হয়ে থাকে।
উপহার এবং মিষ্টান্ন সম্বৃদ্ধ ডালা কূলা ইত্যাদি উপঢৌকন এই দিনে নেয়া হয়। সেগুলি মোড়ানো এবং সাজানো হয় সুন্দর ও নান্দনিক
শৈলীতে যা বিবাহের থিম ও একেক পরিবারের রুচী ,নান্দনিকতা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট
বিবৃতি দেয়। পুরো আয়োজনটিই অতি চমৎকার।
উপস্থাপনাটিকে অভিনব দেখানোর জন্য পরিবার এবং বন্ধুরা এই সাজানোতে দারুন সবতঃস্ফুর্তভাবে
অংশ নেয়। স্পষ্টতই দুটি গ্রুপ তাদের ব্যক্তিগত রুচিশীলতা ও
শিল্পনৈপুণ্য উপস্থাপনে একে অপরের সাথে এক শৈল্পিক প্রতিযোগিতায় মেতে থাকে।
এই অনুষ্ঠানের মূল ঐতিহ্য হলো হবু বর
বা বঁধুর পাশে বসে পরিবার ও বন্ধুরা তাঁর কপালে হলুদের ছোঁয়া ও সুবাসের প্রলেপ দিয়ে দেয়, ঠিক যেন এক স্নেহচুম্বন। হবু বর বা বঁধুর সামনে সুসজ্জিত থাকে সুসবাদু মুখোরোচক
সব খাদ্যের ভান্ডার। এর থেকে তাঁদের অনুমতি বা পছন্দ সাপেক্ষে কোনো খাবার সামান্য মুখে তুলে দেয়া হয়।
চিরাচরিতভাবে অতীতে পরিবার এবং বন্ধুরা মজাদার প্যারোডি ব্যবহার করে অতিথিদের নিয়ে নির্দোষ বিনোদনমূলক কবিতা পাঠ করতো, যা অতিথিদের খুবই নির্মল আনন্দ দিতো । আরো ছিল শুকনো এবং সিক্ত উভয় রকমের রঙের খেলা । অতীতে, এটি একটি ছোট্ট পারিবারিক বিষয় ছিল। অন্তরঙ্গ এবং ব্যক্তিগত। কিন্তু আজকের সময়ে,
এটি একটি অত্যাবশ্যক বর্নাঢ্য অনুষ্ঠান।এবং বলিউডের গানে ঠোঁট মেলানো এবং নৃত্যের অনুষ্ঠানগুলি
এই আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
মেহেন্দি: হেনা উৎসব
এটি এমন একটি অনুষ্ঠান, যাতে কনের হাত মেহেদীর মাধ্যমে নান্দনিক ডিজাইন দিয়ে রাঙ্গানো হয়। এমনও বলা হয় যে মেহেন্দি (মেহেদি) এর রঙ যত গভীর হয়, কনের প্রতি বরের ভালবাসা ততই দৃঢ় হয়। একমাত্র এটিই শুধুমাত্র মেয়েদেরই অনুষ্ঠান যেখানে সংগীত এবং নৃত্যের আয়োজন রয়েছে এবং নারী আত্মীয়া বন্ধুরা আনন্দময়
মুহূর্তটি উদযাপন করতে মেহেদী পরেন। কথিত ছিল যে কনে যখন বরের বাড়িতে যায় তখন তার মেহেদীর রঙ বিবর্ণ না হওয়া অবধি তার
কাছে বাড়ির কোনো কাজ করার আশা করা হয়না।
নিকাহ ঃ স্বীকৃতি
একটি মুসলিম বিবাহের মধ্যে 'নিকাহ' হলো বিয়ের অনুষ্ঠান। এটি সাধারণত কনের বাড়িতে
অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটি কাজী ( মুসলীম ম্যারেজ রেজিস্টার) দ্বারা পরিচালিত । এতে নিকটাত্মীয়রা সাক্ষী হয়। কাজী কুরআন থেকে সংশ্লিষ্ট আয়াত পড়ে তার পরে বিয়ের প্রস্তাব ও গ্রহণযোগ্যতাকে স্বীকৃতি দেয়।
একটি মুসলিম বিবাহের ক্ষেত্রে, বিবাহের বৈধতা, অর্থাৎ পারস্পরিক সম্মতিই হলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন। এই অনুষ্ঠানের সময় পরিবারদ্বয় 'মোহরানা” র পরিমাণ, বর কনেকে বাধ্যতামূলক
যে আর্থিক উপহার দেবে, তার হিসাবে নির্ধারণ করে। 'নিকাহ-নামা' কনে এবং বর দ্বারা স্বাক্ষরিত একটি আইনী দলিল যাতে উভয় পক্ষের মেনে চলতে
হবে এমন শর্তাদি এবং শর্তাবলীর একটি তালিকা উল্লেখিত থাকে। নিকাহ বা এজেন গ্রহন সাধারনত সকাল বা বিকেলে বর কনে উভয়ের
জন্য তাঁদের যার
যার বাড়িতেই সম্পাদিত হয়।
বর যাত্রা: বিয়ের প্রক্রিয়া
বিশেষ প্রার্থনা দিয়ে বরের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে তাঁর মায়ের কাছে দোয়া নিয়ে অতঃপর তাঁর অন্যান্য প্রবীণদের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে পাগড়ি বাঁধার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। প্রথাগতভাবে বরের কাছে তাঁর বাবার পাগড়ি সামগ্রী হস্তান্তর করা হয় যা তাঁর সৌভাগ্য আনয়নের রীতিস্বরূপ । বিবাহের এই আপাত অপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপটি বরের পরিবারের পক্ষে খুব শুভ হিসেবে প্রচলিত। অশুভ দৃষ্টি এড়ানোর জন্য কখনও
কখনও পাগড়িতে 'সেহরা' বা একটি ফুলের ওড়না দিয়ে বরের মুখ ঢেকে দেয়া হয় যা খুব প্রতীকী।
পরিবার সামনে ছোটদের এবং পিছনে বয়স্ক এবং আরও পেছনে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের নিয়ে বরযাত্রী এগিয়ে যায়। বর থাকে সবার মাঝখানে । পূর্ববর্তী
সময়ে, আর্থিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে, বর হাতি বা ঘোড়ায় চড়তেন বা ঘোড়া টানা গাড়িতে বসতেন। আজকের দিনে একটি সুসজ্জিত
গাড়ি ব্যবহৃত হয় এবং বরের গাড়ি ফুলের অলঙ্কারে সুসজ্জিত করা হয়।
বিবাহ/ বিয়েঃ
বিয়ে প্রচলিতভাবেই একটি বহুল ব্যয়সাদ্ধ কিন্তু অতি পুলকময় এক ঘটনা। পুষ্পশোভিত অলঙ্করণ, মঞ্চের জন্য বিস্তৃত অংগসজ্জা এবং বসার জায়গা - সবই অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়।
পরিবেশটি চিরন্তন মহিমাকেই যুগ কাল পেড়িয়ে প্রতিধ্বনিত করে । জনপ্রিয় থিমগুলির মধ্যে
কয়েকটি হলো রেগুলার বা বারোয়ারী, ক্লাসিক, আধুনিক, সুপ্রাচীন এবং বহিরাঙ্গন।
পরিবেশটি হয় মনোমুগ্ধকর এবং আনন্দদায়ক । 'রুসমত' অনুষ্ঠানটি বড়সংখ্যক শ্রোতার সামনে অনুষ্ঠিত হয়। বর এবং কনেকে এসময়ে কিছুক্ষনের জন্য একই পর্দার নীচে রাখা হয় এবং বরটিকে তাঁর ও কনের মাঝখানে ধরা
আয়নায় কনেকে প্রথম দৃষ্টিতে দেখে তার অনুভুতির প্রেমময় প্রকাশ করতে হয়।
কনের ছোট ভাই বোন কাজিন এবং বন্ধুরা বিয়ের হলের প্রবেশদ্বারেও প্রবেশের অর্থ দাবী করে বরকে গেটে জিম্মি করে চাঁদা আদায় করে। এমনকি বরের জুতা লুকিয়েও চাঁদা
আদায়ের লক্ষ্যে থাকে।এসবই দুই পক্ষের কাছে
স্বীকৃত নির্দোষ মজা ছাড়া অন্যকিছু নয়। এসবের মাধ্যমে ছোট ভাই বোনেরা তাদের মোটা
পকেটমানি পেয়ে খুবই উল্লসিত থাকে।
কনে বিদায়: কনের স্থানান্তর মুহুর্ত
প্রথাগতভাবে নববধূকে বরের হাতে তুলে দেয়া কনের বাবার গুরুদায়িত্ব।
কনের নির্ধারিত জীবনসঙ্গীর সাথে একটি নতুন জীবন শুরু করার জন্য তাকে তার
বাবা-মা এবং আত্মীয়গন অনেক শুভকামনা
, ভালোবাসা ও আশীর্বাদ দিয়ে বিদায় জানায় ।
এটি একটি অত্যন্ত আবেগময় মুহূর্ত; বরপক্ষের জন্য অনেক আনন্দের, কিন্তু মেয়েটির
পরিবারের জন্য খুবই বেদনাবিধুর। আগের যুগে নববধূকে অনেক বেশি
পথ পাড়ি দিতে হতো , কারন অবস্থাপন্ন পরিবার ছিল খুব বিরল এবং বরের বাড়ি কনের বাড়ির দূরত্ব ছিল খুব বেশী।গ্রীষ্মপ্রধান এই দেশে
দীর্ঘ পথ পালকীতে আবদ্ধ থেকে এক দুঃসহ, অনেকাংশে প্রানঘাতি পথ পাড়ি দিতে হতো। পথে
কনের পালকীতে ডাকাত পরা বা ঝড়ে নৌকাডুবির ঘটনাও ছিল প্রচুর।
আজ দেখা যায় অনেক বর - কনের পরিবারই একই গ্রামে, এমনকি একই পাড়ায় বা লোকালয়ে বাস করে।
বধু বরণ: নববধূকে স্বাগতম
নবদম্পতি বরের বাড়িতে পৌঁছনোর সাথে সাথে নব দম্পতিকে আশীর্বাদের সাথে সবাগত জানানো হয় । বরের মা এই আচারের প্রধান
ভূমিকায় থাকেন। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে পবিত্র কুরআনের আয়াত পাঠসহ এই আচারটি করা যায়।
কেউ কেউ এই প্রথায় ভুট্টা ভাত ব্যবহার করতেন ভাল ফসল এবং প্রচুর ফলনের প্রতীক
হিসেবে এবং ঘাসের জমি ব্যবহার করতেন কনে যে পথে চলবেন তার সূগমতার প্রতীক
হিসাবে । বধু বরনের ডালায় বিশেষ আহারাদি মিষ্টি এবং একটি তেল প্রদীপ স্থাপন করা হয় যা ভালবাসা এবং
বন্ধনের অসীম চেতনা উপস্থাপন করে। সনাতন ধর্মে কখনও কখনও নববধূকে আলতা রাঙ্গা থালায় এবং দুধে পা
রেখে তারপর ভেতরে ঢুকতে বলা হয়, যাতে
স্থায়ীভাবে তার প্রথম ছাপ তার নতুন বাড়িতে পা ফেলে।
বাসর ঘোর: ফুল শয্যা , বিয়ের প্রথম রাত
ঐতিহ্যগতভাবে শোবার ঘরটি বিয়ের রাতের জন্য প্রস্তুত করা হয়। সুগন্ধযুক্ত ফুলের টানা ঝুল দিয়ে বিছানার চারপাশে পর্দা
তৈরি করা হয়, যা বিছানার উপর থেকে ঝুলে থাকে । এছাড়া ফুলের পাপড়ির বিভিন্ন প্যাটার্নে শয্যাটিও সাজানো হয় । সব কিছুরই
উদ্দেশ্য থাকে নব দম্পতির জীবনের প্রথম রাতটি স্বপ্নময় সুন্দর করে দেয়া।
সকালের নাস্তা: বিয়ের পরদিনের প্রথম আহার
বিয়ের পরের দিনের প্রথম খাবারটি অনেক বাংলাদেশি পরিবারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যবাহী খাবারের বিস্তৃত ভাণ্ডারে কনের পরিবারের পক্ষ থেকে এই খাবারটি বরের
বাড়িতে প্রেরণ করা একটি সম্মানীয় রীতি। বাড়ির তৈরি মিষ্টান্ন এবং প্রচুর রকমের নাস্তাদ্রব্য, কাবাব, তরকারী, ঝাল বা মিষ্টি পিঠা (চালের পিঠা)
এবং ফলমূল দিয়ে এই নাস্তার ভান্ডার পূর্ন থাকে।
বউভাত : বিবাহোত্তর সম্বর্ধনা
এটি নবদম্পতিতে সম্মান জানাতে এবং তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে
দেওয়ার জন্য বরের পরিবার কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানেই অনেকে প্রথমবারের জন্য কনের সাথে দেখা করে। এই অনুষ্ঠান কনের পরিবারের আয়োজিত বিয়ের দিনের আতিথেয়তার জন্য বরের পরিবারের পক্ষ থেকে পাল্টা আতিথিয়তার সুযোগ।
অতিথিদের জন্য বিবাহ এবং 'বউ ভাত' উভয় সময়ে উপহার প্রদান করা সাধারণ রীতি । তবে এই অনুষ্ঠানের এই নামকরনের ইতিহাস হলো, অতীতে এটি ছিল একটি ভোজ যাতে
কনে তার শ্বশুরবাড়িতে নিজ হাতে প্রথম রান্না করতেন তাঁর
নতুন পরিবার এবং তাঁর বাপের বাড়ির নিকটতম
সদস্যদের জন্য ।
ফিরানীঃ বিয়ের পর সবামীসহ বাবার বাড়ি
প্রচলিত রীতিতে বউভাতের অনুষ্ঠান শেষে বর বউকে নিয়ে কনের বাড়ির সবাই কনের
বাড়ি ফিরে আসেন। নতুন পরিবারে বউয়ের অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে উন্মুখ ভাই বোন
আত্মীয়দের ঘিরে হাসি আনদমুখর দুই থেকে তিনদিন নতুন কনে বাবার বাড়িতে বরকে নিয়ে
কাটান। জামাই আদরের প্রথম ঘরোয়া এই সুযোগে কনের আত্মীয়রাও বরের সাথে ঘনিষ্ট হবার
চমৎকার সুযোগ পায়।
পরিসমাপ্তিঃ
বাংলাদেশী বিবাহের আয়োজনটি সাংস্কৃতিক, সামাজিক বা অঙ্গসজ্জার শৈল্পিকতায়,
সব দিক থেকেই
পরিবর্তনের বিশাল ঢেউয়ের ভেতর দিয়ে গেছে। শত সহস্র সূক্ষ সূক্ষ দিক যা আমাদের চিরন্তন বিবাহরীতিকে সংজ্ঞায়িত করে তা এখন বৈশ্বিক স্কেল এবং শৈলীতে উপস্থাপিত হয়। নব
নব অভিনব সব ডিজাইনের অনুপ্রেরণায় এখন আর কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানকে
স্থানীয় ধ্যান ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারে না। তবে আমাদের উচিত আমাদের সংস্কৃতিগত এসব সুন্দর প্রথাগুলিকে সংরক্ষণ করা এবং সুন্দরভাবে লালন করা, যা আমাদের জাতিগত ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবিকেই উপস্থাপন করে।
সূত্র: ডেইলি স্টার
Copyright Ⓒ 2021 DeshiWedding.com All rights reserved.
1 Comment(s)
বিয়ের প্রথম রাতে কি হয়, সে বর্ননা মিসিং
Leave a Comment